# প্রশাসনিক তৎপরতায় ধীরগতি
# গণপদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে
# গ্রেপ্তারের ভয় ও অনিশ্চয়তা
# সচিবের পদ শূন্য হওয়ায় ব্যাহত কার্যক্রম
# আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব তীব্র হওয়ার শঙ্কা
মহিউদ্দিন তুষার: দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ পরিচালনায় এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে দ্বৈতনীতিতে চলছে প্রশাসনের কার্যক্রম। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে জনপ্রশাসনে অসন্তোষ ও উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের স্বৈরশাসন, দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির কারণে জনপ্রশাসন একটি দলীয় কাঠামোতে পরিণত হয়েছিল। সরকার পতনের পর সেই কাঠামো স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়ে। দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তারা প্রশাসনিক পদসোপান কাঠামো ভেঙে এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিন ধাপে পদোন্নতি নেওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছে। বঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি বঞ্চিত সেজে কিছু সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলছে এমন কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে ভিড় করছেন তদবিরকারী কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন ক্যাডারের এই বিশৃঙ্খলায় বঞ্চিত অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের একটি সুপারিশকে কেন্দ্র করে প্রশাসনে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। বর্তমানে প্রশাসন থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এমন পরিস্থিতিতে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে জোট বেঁধেছেন বিসিএস ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি করে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন আমলারা। প্রশাসনে এমন চলমান অস্থিরতার মধ্যেই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুরক্ষিত দপ্তর বাংলাদেশ সচিবালয়ে মধ্যরাতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। যার কারনে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। এটি নাশকতা, না-কি স্বাভাবিক অগ্নিকাণ্ড এ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় ৮ আগস্ট। এ সরকারের প্রায় পাঁচ মাসে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এই সময়ে ৫৩৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সচিব করা হয়েছে ২৩ কর্মকর্তাকে। গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৭ জন। অতিরিক্ত সচিব ১৩৫, যুগ্ম সচিব ২২৮ এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ১৩৪ জন।
আবার কোনো কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করার পর চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বদলির আদেশ পরে প্রত্যাহার করতে হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। সাবেক সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রশাসনে এবারই প্রথম এত সংখ্যক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেন। এবারই সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে সচিবদের নামে। এ নিয়ে জনপ্রশাসনে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।
আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে বড় ধরনের অস্থিরতা ও কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। বছরের শেষের দিকে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব তীব্র হওয়ায় এখনও বিশৃঙ্খলার অবসান হয়নি। প্রাথমিকভাবে সরকারি সেবা সহজীকরণের জন্য কমিশন গঠন করা হলেও এটি এখন কর্মকর্তাদের নিজস্ব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে।
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ঘন ঘন বদলি আদেশ বাতিল এবং পোস্টিংয়ে অসঙ্গতির মতো বিশৃঙ্খলার ঘটনাগুলো সমন্বয়ের অভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পূর্ববর্তী সরকারের আমলে করা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে। পরে সরকার ১৪টি মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেয়। কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করে আবার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। তদবির করে কেউ কেউ বদলির আদেশ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। আবার সমন্বয়হীনতার কারণে বদলির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে সরকারকে। এতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। চলমান বিঘ্নের কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর হয়ে পড়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ মাসে ৫৩৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ জন সচিব, ১৭ জন গ্রেড- ১,১৩৫ জন অতিরিক্ত সচিব, ২২৮ জন যুগ্ম সচিব এবং ১৩৪ জন উপসচিব রয়েছেন। এখন এসব পদোন্নতির মানদণ্ড নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতির অভিযোগে উঠেছে। সাবেক সচিবসহ ১২ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর ফলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সেতু বিভাগ- এই ৪টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সচিববিহীন থাকায় তাদের কর্মকাণ্ড ও পরিচালনায় বিঘ্ন হচ্ছে। সংস্কার কমিটি আগেই বঞ্চিত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে সচিব পদে ১১৯ জনসহ বিভিন্ন পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে প্রশাসনের ওপর এত চাপ তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছরে ব্যাপক দলীয়করণ, সেটা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের কারণে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, প্রশাসনে কাজের গতি খুবই মন্থর। মানুষ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন রাজনৈতিক চাপ নেই। কর্মকর্তাদের উচিত, আদাজল খেয়ে কাজে নেমে পড়া। এটা করলে কর্মকর্তাদের আত্মমর্যাদা ও সম্মান বাড়বে। প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের দুর্নাম গোছানোর এখনই সময়।
এমটি/ এএটি