* ২০১২ সালে বিশ্বজিৎ দাস
* ২০১৯ সালে আবরার হত্যা
* বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গেস্ট রুম নামে নিপীড়ন
* নিরাপদ সড়ক, কোটা সংস্কার আন্দোলনে দমনকারীর ভূমিকা
* ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অন্তত অর্ধশত প্রাণহানি
* তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেন
* ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অস্ত্র হাতে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মারমুখী
* টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নসহ নানান অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
মহিউদ্দিন তুষার: ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে সংগঠনটির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শক্তি ছিল ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠন। তবে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির মূলনীতি নিয়ে গঠিত ছাত্রসংগঠনটির নিকট ইতিহাসে প্রায়ই উঠে এসেছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণকাণ্ডের মতো গুরুতর অপরাধ। এই ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব, মারামারি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক বাণিজ্য, বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচিতে হামলা, দমনপীড়ন, অস্ত্রবাজির মতো অপরাধের শত শত অভিযোগ ওঠে।
স্বামীকে হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগ ব্যাপক ঘৃণা ও ধিক্কার কুড়ায়। এর আগে ১৯৯৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন করেন। গত ১৫ বছর কিংবা আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০০ শাসনেও প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সংগত আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমনের জন্য ছাত্রলীগের ক্যাডারদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু বিরোধী দমনই নয় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অর্ধশত প্রাণহানি ঘটেছে।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় দরজি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান। একই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদকে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেন শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার। পরে ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন আদালত।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সন্ত্রাসের লীলাভূমিতে পরিণত করে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এই সংগঠনের নেতাদের কক্ষগুলো একেকটি অস্ত্রভান্ডার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করলেও তারা ছিল আইনের ঊর্ধ্বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর শ্বেতসন্ত্রাস চালাতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘গেস্ট রুম’ নামে নিপীড়নের কুখ্যাতিও রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল দমনকারীর ভূমিকায়। চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালে সমালোচনার মুখে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী (শোভন) ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান শুরুর পর শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মারমুখী ছিল ছাত্রলীগ। গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নজিরবিহীন মারধর করে, যা থেকে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিনেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর অভ্যুত্থান দমনে অস্ত্র হাতে রাজপথে দেখা যায়। অভ্যুত্থানের সময় এবং শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র পাওয়া যায়। মধ্য জুলাই থেকেই অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বের করে দিয়েছে অভ্যুত্থানকারীরা। ৫ আগস্টের পর ছাত্রলীগের তৎপরতা স্যোশাল মিডিয়ায় কিছু দেখা গেলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না।
ছাত্র- জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হলে শেখ হাসিনাসহ তার দলের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে যায়। কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করতে পারলেও আবার অনেকে দেশের মধ্যেই আত্মগোপনে আছেন। এর মধ্যে অনেক মন্ত্রী, এমপি রয়েছেন রিমান্ডে কিংবা জেল হাজতে। হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছিল।
গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাদের ঘোষিত পাঁচ দফা দাবির দ্বিতীয়টি ছিল ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এই সপ্তাহের মধ্যে আজীবন নিষিদ্ধ করতে হবে। এরই মধ্যে গত বুধবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেখান থেকে ছাত্রলীগকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে নিষিদ্ধ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
পরে গত বুধবার রাতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বিগত ১৫ বছর ধরে হত্যা, নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও জননিরাপত্তা বিঘ্নসহ নানা অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১৮-এর উপধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি করে।
সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনন্দ মিছিল করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন। এছাড়া নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রায় সব ছাত্র সংগঠনই।
একাধিক অভিভাবক জানান, সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় হত এই ছাত্রলীগের জন্য। তারা ছাত্র সংগঠনের নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর এক প্রকার জুলুম এবং নির্যাতন করতো। সন্ত্রাসী এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করায় চিন্তা মুক্ত হলাম।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, কল্পনাও করতে পারছি না আমাদের ক্যাম্পাসে এখন থেকে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসীরা নাই। আশা করি আর কোন ছাত্র সংগঠন নামে সন্ত্রাসীদের জন্ম হবে না। বাবা-মা তাদের সন্তানদের এখানে পড়া-লেখা করতে পাঠিয়। কিন্তু দু:খের বিষয় হল বিগত দিনে ছাত্র রাজনীতির নামে যা হয়েছে তাতে করে পড়া-লেখার কোন পরিবেশই ছিল না। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে ক্যাম্পাসগুলোতে ভালো একটা পরিবেশ তৈরি হবে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্রলীগের নিষিদ্ধের মাধ্যমে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগকে শুধু নিষিদ্ধ নয়, তাদেরকে হত্যা, নির্যাতন ও দখলদারিত্বের জন্য বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাদের নির্দেশ দাতা আওয়ামিলীগের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে আর রাজনীতিতে দেখতে চায় না। ছাত্রলীগকে দেখা মাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে। সব জঙ্গি সংগঠন মিলে যত শিক্ষার্থীকে মেরেছে, তার ছেড়ে বেশি একা ছাত্রলীগ মেরেছে বলে জানান তিনি।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম বলেন, ছাত্রলীগকে শুধু নিষিদ্ধ নয়, আইন অনুযায়ী ওদের প্রতিটা হত্যাকান্ডের বিচার করতে হবে। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা জানায়, ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী প্রমাণিত করে নিষিদ্ধ করায় সাধুবাদ জানায় ছাত্র ইউনিয়ন।