বিশেষ প্রতিবেদক: মন্ত্রী, এমপি রাজনীতিবিদসহ দলীয় শীর্ষ নেতা, দুর্নীতিবাজ শিল্পপতি এবং চাকুরি থেকে বহিস্কৃত আইন শৃংখলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে দেশের কেন্দ্রীয় কারাগারগুলো। কারাগারে বিশেষ সুযোগ সুবিধা পেতে কারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সিংহভাগ ভিআইপি বন্দি। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তারা এসকল সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। তাদেরকে প্রথম শ্রেণির বন্দির মর্যাদা দেয়ার পরও তারা কারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। কারাবিধির বাইরে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। সুস্থ থেকেও তারা বিশেষ কারণে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কারা সূত্র বলেছে, ভিআইপি বন্দিদের সিংহভাগই বয়স পঞ্চাশের উর্ধ্বে। অনেকের বয়স ৬০ বছর থেকে ৭৫ মধ্যে। অতিরিক্ত সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অধিকাংশ ভিআইপি বন্দি বয়সের ভারে কারাগারের সেলে নুইয়ে পড়েছেন। রোগে শোকে এবং দুশ্চিন্তায় (ডিপ্রেশনে) খাওয়া এবং ঘুম কমেছে। তারা এখন সেলে বসে খবরের কাগজ, ধর্মীয় বই, কিতাব পড়েন। তাছাড়া নামাজ আদায়ের পাশাপাশি সুরা ও কোরানের আয়াত পড়ে সময় কাটাচ্ছেন।

কারাসূত্র বলেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণহত্যায় জড়িতসহ বিভিন্ন অপরাধে ৫ অক্টোবর দুপুর পর্যন্ত ৭৬ জন ভিআইপি মর্যাদার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শিল্পপতি, পুলিশের আইজি, সাবেক ডিএমপি কমিশনার, সম্প্রতি দায়িত্ব পালনকারী কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

কারাসূত্র মতে, ভিআইপি বন্দির সংখ্যা ছিল ৭৬ জন। তাদের মধ্যে ডিভিশন পেয়েছেন ৪৩ জন। হাসপাতালে আছেন ৯ জন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ডিভিশনপ্রাপ্ত ভিআইপি বন্দির মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খান, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামছুল হক টুকু, সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, সাবেক সংসদ সদস্য আহম্মেদ হোসাইন, সাবেক রিয়াল অ্যাডমিরাল এম সোহাইল, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সোবহান গোলাপ, হাজী মো. সেলিম, সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাসান চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি আবুল হোসেন মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, সাবেক সংসদ-সদস্য শাহে আলম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফি, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, কুষ্টিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জজ, ডিআইজি মিজানুর রহমান, পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এবং যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান।

কারাগারে আটক বন্দির খাবারের বিষয়ে ডেপুটি জেলার আরিফুর রহমান জানান, ভিআইপি বন্দিরা সকালে রুটি-সবজির সঙ্গে জেলি পান। সাধারণ বন্দিদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা না থাকলেও ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের চা কফি বিস্কুট দেওয়া হয়। সাধারণ বন্দিরা মাছ/মাংস পান একবেলা। কিন্তু ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা দুই বেলা মাস/মাংস পান। কিন্তু পরিমাণ সবার জন্য সমান।

সূত্র জানায়, ভিআইপি বন্দিরা কারাগারে কাজের জন্য (ফুটফরমায়েস) লোকও পান। কাজের লোক একধরনের সেবক হিসাবে কাজ করেন। ওই সেবক ভিআইপি বন্দির কাপড় ধুয়ে দেন, খাবার সংগ্রহ করে দেন, প্লেট ধুয়ে দেন। এছাড়া আনুষঙ্গিক কাজ করে দেন।

কারা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই কেউ কেউ নামাজ পড়ছেন। কেউ দেরিতে ঘুম থেকে উঠছেন। কমবেশি সবাই নামাজ পড়ছেন। চা-নাশতা খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন, গল্প-গুজব করেন, পত্রিকা পড়েন। কেউ কেউ কারা লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়েন। দুপুর ১২টার পর গোসলে যান। গোসল শেষে কেউ কোরআন তেলাওয়াত করেন, নামাজ পড়েন। বিকালে নির্ধারিত করিডোরে হাঁটেন।

সাধারণ বন্দি ও ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিরা থাকার জন্য একটি খাট পান। চেয়ার-টেবিল পান। কারা লাইব্রেরিতে সবার জন্য পত্রিকা পড়ার সুবিধা আছে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সাধারণ বন্দিরা নিজ খরচে রুমে নিয়ে পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য কারা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের রুমে পত্রিকা পড়ার সুযোগ করে দেন। তারা টেলিভিশন দেখারও সুযোগ পান।

কারাসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভিআইপি বন্দিরা কারাগারে বিশেষ সুবিধা দাবি করলেও তাদের তা দেওয়া হচ্ছে না। কারাবিধি অনুযায়ী তারা যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা, সেগুলোই তাদের দেওয়া হচ্ছে। বিধি অনুযায়ী প্রতি ১৫ দিন পর নিকটাত্মীয়রা বন্দিদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। নিয়ম অনুযায়ী নিকটাত্মীয় ছাড়া বন্দিদের সঙ্গে কারও দেখাসাক্ষাতের সুযোগ নেই। তবে বর্তমানে কারাবন্দি ভিআইপি বন্দিদের সঙ্গে কোনো নিকটাত্মীয়ই দেখা করছেন না। তবে ম্যানেজার টাইপের কেউ একজন এসে দেখা করছেন। তিনিই মামলার খোঁজখবর রাখছেন।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, একজন বন্দি প্রতি ১০ দিন পর একদিন নির্ধারিত মোবাইল নম্বরে কারাগারের ভেতর থেকে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ বন্দিদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ এখনো কেউ পাননি।

এবিষয়ে কারা অধিদপ্তর ডিআইজি প্রিজন্স (ঢাকা বিভাগ) জাহাঙ্গীর কবির এই প্রতিবেদককে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী যারা ডিভিশন পাওয়ার তারা পেয়েছেন। এর বাইরে কয়েকজন ডিভিশন পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। আদালত সিদ্ধান্ত দিলে তারা তা পাবেন। কারাগারের নির্ধারিত যে খাবার তাই খাচ্ছেন ভিআইপি বন্দিরা। এর বাইরে বাড়তি খাবার কেউ নিতে চাইলে পিসির মাধ্যমে ( প্রিজনার ক্যাশ) তা নিতে পারেন। আর বাহির থেকে তাদের বাসার রান্না করা কোনো খাবার খেতে দেওয়া হচ্ছে না।

সম্প্রতি গ্রেপ্তার সবাইকে কয়েকটি ভাগে পৃথক কক্ষে রাখা হয়েছে। কারণ সাধারণ সেলগুলোতে অন্য বন্দিদের সঙ্গে রাখলে তাদের সমস্যা হতে পারে। এছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থেও একই জায়গায় তাদের রাখা হয়নি। তারা সকলেই সুস্থ এবং ভালো আছেন বলে তিনি জানান।

এমটি/ এএটি

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email