বিশেষ প্রতিবেদক: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিতে আসছে সাধারণ ভোটারদের চায়ের কাপের আড্ডা ততই জমে উঠেছে। নির্বাচনে বিএনপি সহ তাদের সমমনা দলগুলো অংশগ্রহণ না করলেও নিবন্ধিত ২৯ দল অংশগ্রহণ করছে। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের মধ্য থেকে ডামি প্রার্থীদের সুযোগ করে দেন। এছাড়া দলের ভেতর থেকে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে অনাপত্তিও জানান। ডামি/স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের সদস্য হওয়ায় দলের অন্যজন সদস্য দলের মনোনীত প্রার্থীর প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে যান। কাগজে-কলমে আওয়ামীলীগের প্রধান প্রতিপক্ষ জাতীয় পার্টি হলেও বেশিরভাগ আসনে নৌকার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ডামি প্রার্থী।

জানা যায়, নৌকার বিপরীতে প্রায় ৭০ জন আওয়ামীলীগের জেলা/কেন্দ্রীয় নেতা ঈগল মার্কা নিয়ে নির্বাচন করছেন। এছাড়া ৩৫ জন করছেন ট্রাক মার্কা নিয়ে। জাতীয় পার্টি দুইশ’র বেশি আসনে প্রার্থী দিলেও তারা লড়াই করছে হাতেগোনা কয়েকটি আসনে। অধিকাংশ স্থানে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ২৬টি আসনে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেওয়ায় কাগজে-কলমে তারা প্রতিপক্ষ হলেও এবারের নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেনি। তাই আওয়ামীলীগের মনোনীত নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন ঈগল এবং ট্রাক মার্কা। অন্য যে সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে তাদের বেশিরভাগ দলই নামকাওয়াস্তে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি না আসায় এবারের নির্বাচনে বড় চমক হবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬০-৭০টি আসনে জয়ী হলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগ যে অবস্থানে আছে সেই অবস্থানে যদি অনড় থাকে তাহলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। এ রকম একটা নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের বহু প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকী অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীরাও নির্বাচনে পরাজিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে নৌকার পরই যে প্রতীকটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেই প্রতীকটি হলো ঈগল প্রতীক। আর ভোটের মাঠে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে নৌকার সাথে লড়াই হচ্ছে ঈগলের।

বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ফরিদপুর-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে লড়ছেন যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। তিনি ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নৌকার প্রার্থী কাজী জাফরউল্যাহকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। আগের দু’বার নৌকার মনোনয়ন না চাইলেও এবার তিনি নৌকার মনোনয়ন চেয়েও পাননি। তাই এবারও জাফরউল্যাহর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।

হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে নিয়ে এক প্রকার বেকায়দায় পড়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। গত দুই নির্বাচনে সহজে জয় পেলেও এবারই তিনি প্রথম ভোটের লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। সুমন সব বয়সী ভোটারদের নিয়ে যেভাবে ঈগল প্রতীকের প্রচার শুরু করেছেন, এবার মাহবুব আলীর নৌকা ঘাটে ভিড়বে কিনা, এ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।

চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরীও স্বতন্ত্রভাবে ঈগল প্রতীকে ভোট করছেন। গাজীপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তার আসনে স্বতস্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনি মাঠে রয়েছেন মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেল। শরীয়তপুর-২ আসনে পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীমের নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী করছেন আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা: খালেদ শওকত আলী। ময়মনসিংহ-৩ আসনে সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকিরের প্রতিপক্ষ হয়েছেন নিজ দলের নাজনীন আলম। ঢাকা-৭ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন। এখানে তাঁর বিরুদ্ধে লড়ছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাজি সেলিম। ঢাকা-১৫ আসনে কামাল আহমেদ মজুমদারের প্রতিপক্ষ বর্তমান সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহর ভাই এখলাস মোল্লা। আবার ঢাকা-১৬ আসনে ইলিয়াস মোল্লাহর বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এস এ মান্নান। ঝিনাইদহ-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক মৎস্য প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক সম্পাদক নায়েব আলী জোয়ারদার। ঝিনাইদহ-২ আসনে শফিকুল ইসলামের প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূর এ আলম সিদ্দিকীর ছেলে তানজীব আলম সিদ্দিকী। এ ছাড়া বাগেরহাট-৪, সাতক্ষীরা-২, টাঙ্গাইল-৬, জামালপুর-২, ময়মনসিংহ-১১, নেত্রকোনা-১, নেত্রকোনা-২, মুন্সিগঞ্জ-২, নরসিংদী-৩, নারায়ণগঞ্জ-১, সুনামগঞ্জ-২, সুনামগঞ্জ-৩, হবিগঞ্জ-৪, কুমিল্লা-১, কুমিল্লা-৬, নোয়াখালী-৬, নড়াইল-২ আসনেও একই অবস্থা।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভাষ্য, নির্বাচনকে অংশগ্রমূলক করার লক্ষ্যে আওয়ামীলীগ সরকার প্রধানের সিন্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েই তারা নির্বাচনের মাঠে নেমেছে। নৌকা প্রার্থীরা তাদের দলের বিদ্রোহী প্রার্থী বলতে চাইলেও দল এ ব্যপারে পরিস্কার করে দিয়েছেন বলে জানান। এ দিকে দলের প্রধান শেখ হাসিনা বলেই দিয়েছে যে যোগ্য তাকে প্রতিযোগিতা করেই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। কেউ জোড় করে কিছু করতে চাইল দল তাকে ছেড়ে দিবে না।

বিভিন্ন জেলার তথ্য থেকে জানা যায়, নির্বাচনি প্রচার শুরু করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি মেলার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মাঝে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

এমটি/ এএটি

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email